HT Bangla Special: বাংলায় গত কয়েক বছর ধরে রামনবমী উদযাপনের বেশ ঘনঘটা। সংশ্লিষ্ট মহলের মতে, এক রাজনৈতিক দলের ‘অনুপ্রেরণায়’ পশ্চিমবঙ্গের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে উন্মাদনা।। বর্তমান বঙ্গ রাজনীতি রামনবমী উদযাপন নিয়েই তোলপাড়। কারণ বাংলায় রামনবমী উদযাপনকে বিভেদ তৈরির অপচেষ্টা বলে মনে করে অন্য রাজনৈতিক দলগুলি। অনেকের দাবি, বাংলায় রামের পুজো কখনই প্রচলিত ছিল না।। অভিযোগ, ভোটের ফায়দা তুলতে একটি রাজনৈতিক দল বঙ্গজীবনের অঙ্গ করে তুলতে চায় রামচন্দ্রকে। কিন্তু বাংলার সুপ্রাচীন ইতিহাস কী বলছে? বঙ্গসংস্কৃতি কি রামনাম থেকে সবসময়ই নিজেকে দূরে রেখেছিল? ১৩ বা ১৪ শতক থেকে নানা ঘটনাবলির ধারা একের পর এক তুলে ধরা যাক। এতেই নিহিত যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর।
বাঙালির অকালবোধন প্রীতি
রামনবমীর সঙ্গে একই দিনে পড়ে বাসন্তী পুজোর লগ্ন। বসন্তকালে দেবী দুর্গার আরাধনাই বাঙালির কাছে বাসন্তী পুজো নামে পরিচিত। বাংলার বাইরে এই পুজোর নাম চৈত্র নবরাত্রি। দুর্গা সপ্তশতী মতে, রাজা সুরথ প্রথম পৃথিবীতে মা দুর্গার পুজো করেন। রাজ্য সম্পদ হারিয়ে তিনি গভীর বনে নির্বাসিত হন। সেখানেই মেধস ঋষির আশ্রম। রাজ্যপাট হারালেও রাজ্যের মঙ্গলচিন্তায় সর্বদা নিমগ্ন থাকতেন সুরথ। মেধস ঋষি তখন তাঁকে মহামায়ার লীলাকাহিনি শোনান। চণ্ডীমাহাত্ম্য শোনার পর তিন বছর কঠোর তপস্যা করেন সুরথ ও সমাধি। এর পর রাজ্যজয়ের পূর্বে দেবী দুর্গার আরাধনা করেন সুরথ। কিন্তু বসন্তকালে সেই পুজো অনুষ্ঠিত হয় বলে, তার নাম বাসন্তী পুজো। সারা বাংলা আজও বাসন্তী পুজো ওই রীতি মেনেই করে।

যেখানেই বাঙালি সেখানেই…
তবে বাংলায় বাসন্তী পুজোর মাহাত্ম্য শারদোৎসবের মতো ব্যাপক নয়। দেবী দুর্গার পুজো হলেও বাসন্তী পুজো ততটা উন্মাদনা ছড়াতে পারেনি আপামর বাঙালির মধ্যে। কারণ বাঙালি আপন করে নিয়েছিল শ্রীরামচন্দ্রের মাতৃ আরাধনাকে। রাবণ বধের পূর্বে রাম জানতে পারলেন, দেবী স্বয়ং রক্ষা করছেন রাবণকে। এমতাবস্থায় রামচন্দ্র অকালবোধন করলেন মায়ের। সেই অকালবোধনের পুজোই আজ বাঙালির পরমপ্রিয় দুর্গোৎসব। শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, নিউইয়র্ক, জার্মানি থেকে লন্ডন, অস্ট্রেলিয়া যেখানেই বাঙালিরা রয়েছেন, সেখানেই অকালবোধন রীতিতে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। বাংলায় দুর্গাপুজোর ইতিহাস ঘাঁটলেও দেখা যাবে, অকালবোধনের পুজোই বরাবর জনপ্রিয় ছিল।
আরও পড়ুন - Ghibli Art: শিল্পীর কল্পনাও কি এবার এআই করে দেবে? জিবলি বিতর্কে ভাবাচ্ছে সেই প্রশ্ন, HT বাংলায় লিখলেন মালি
নদিয়ার গর্ভ থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ
দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গ থেকে সরে আসা যাক। রামচন্দ্রের জনপ্রিয়তা লক্ষ করা যায় বঙ্গভূমিতে রামায়ণ অনুবাদের প্রয়াসেও। ১৪ শতকের শেষের দিক। শান্তিপুরের কাছে ফুলিয়ায় জন্ম হল মধ্যযুগের অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবি কৃত্তিবাস ওঝার। নদিয়া তখন বাংলার সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র; স্মৃতিশাস্ত্র, তর্কশাস্ত্রে পণ্ডিতদের বাসভূমি। তেমনই এক পণ্ডিত গৌড়েশ্বর গণেশনারায়ণ ভাদুড়ির পৃষ্ঠপোষকতায় বাল্মীকি রামায়ণের সহজবোধ্য বাংলা অনুবাদ করেন কৃত্তিবাস। আজ যা কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে সমাদৃত। এর থেকে স্পষ্ট, বাংলায় রামের পুজো ও রামনাম সংকীর্তনের প্রচলন তখনও ছিল।

শ্রীরামকৃষ্ণের রামপুজো
১৯ শতকের বাংলা। সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রবাদপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব হল বাংলায়। অত্যাধুনিক ধর্মমতের পথপ্রদর্শক রামকৃষ্ণ যে রামচন্দ্রের পুজোও করবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী। ঠাকুরের সে পুজো যেন ভক্ত ও ঈশ্বরের পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিফলক। রামের আরাধনার সময় শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ ভক্ত হনুমানের রূপ ধারণ করলেন। চোখের ক্ষিপ্রতা, সাজ, কার্যকলাপ হয়ে উঠল রামভক্ত হনুমানের মতোই। আজ অনেক ভক্তই শ্রীরামকৃষ্ণকে রামচন্দ্রের অবতার বলে মনে করেন।
রানি রাসমণির প্রিয়তম দেবতা যিনি
বাংলার অভিজাত শ্রেণির ঘরেও আরাধ্য ছিলেন রাম। শ্রীরামকৃষ্ণের লীলাক্ষেত্র ছিল দক্ষিণেশ্বর। আর এই দক্ষিণেশ্বর নির্মাণের নেপথ্যে জানবাজারের রানি রাসমণি। ধনী জমিদার বাবু রাজচন্দ্র দাসের স্ত্রী রানি রাসমণির জীবনী যাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁদের লেখায় পাওয়া যায় রঘুবীরের রথযাত্রা প্রসঙ্গ। রাসমণির প্রিয় আরাধ্য দেবতা ছিলেন শ্রীরাম। জামাই মথুরকে একদিন রানি ডেকে বললেন, রূপোর রথে চড়িয়ে কলকাতার রাজপথে ভ্রমণ করাতে চান তাঁর দেবতাকে। সেইমতো আয়োজন হল। ব্যয় হল বিপুল। বর্ণাঢ্য হল রঘুবীরের রথযাত্রা।
রাম বাংলার যে যে স্থানে
শ্রীরামপুর, রামরাজাতলা, রঘুনাথপুর। বাংলার একাধিক স্থানের ইতিহাসের সঙ্গে রাম পুজোর ইতিহাস জড়িত ওতপ্রোতভাবে। বিভিন্ন স্থাননামে রাম শব্দটি আছে বলেই রাম বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ- বিষয়টা এত সরল না হলেও বাংলায় রামের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। হাওড়ার রামরাজাতলায় পূজিত হন রাজা রামচন্দ্র। গাত্রবর্ণ সবুজ, গুম্ফসমন্বিত মুখমণ্ডল। তাত্ত্বিকদের মতে, বাঙালির নিজস্ব মূর্তি নির্মাণের কায়দা মেনে গড়া রামের এই মূর্তি। রামের পুজোর পর এখানে প্রায় চার মাস ধরে মেলা চলে। যা বাংলার বৃহত্তম মেলা। পুরুলিয়ার বিখ্যাত শহর রঘুনাথপুর। শহরের নামকরণ হয়েছিল ওই এলাকার এক মন্দিরের নামে, রঘুনাথ জিউর মন্দির, প্রায় ৩০০ বছর পুরনো। রঘুনাথ জিউ আদতে শ্রীরামচন্দ্র। আবার শ্রীরামপুরের নামের উদ্ভব প্রসঙ্গে তাত্ত্বিকরা বলছেন শ্রীপুর বা শ্রীরাম শব্দদ্বয়ের কথা। হুগলির ওই অঞ্চলের বেশ কিছু স্থানে ব্রাহ্মণ জনগোষ্ঠীর আধিক্য দেখা যায়। গোস্বামীপাড়া, লাহিড়ীপাড়া, মুখার্জীপাড়া, ভট্টাচার্যপাড়া, চক্রবর্তীপাড়া ইত্যাদি পাড়াগুলির নামকরণ সেই মতেই বলে মনে করা হয়। আবার পুজোপার্বণের চল জন্ম দিয়েছে পটুয়াপাড়া, কুমোরপাড়া, ঢুলিপাড়ারও। ফলে স্থানের নাম শ্রীরামপুর হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

সম্প্রীতি যে ভূমির শিরায় শিরায়
বঙ্গজীবনে রামচন্দ্রপ্রীতি প্রবলভাবে না থাকলেও রামের পুজোর প্রতি বাঙালির বিরাগের প্রমাণ সেভাবে পাওয়া যায় না। বরং বাংলাই একাধিক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত নির্মাণ করেছে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ, বাঙালির পরমপ্রিয় নজরুলগীতি।
মন জপ নাম শ্রীরঘুপতি রাম
নব দূর্বাদলশ্যাম নয়নাভিরাম!
সুরাসুর-কিন্নর-যোগী-মুনি-ঋষি-নর
চরাচর যে নাম জপে অবিরাম॥
সজল-জলদ-নীল-নবঘন কান্তি
নয়নে করুণা, আননে প্রশান্তি।
নাম শরণে টুটে যায় শোক-তাপ-ভ্রান্তি,
রূপ নেহারি মূরছিত কোটি কাম॥
নজরুল শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। তাঁর লেখা এই গান নিঃসন্দেহে সম্প্রীতির পথপরিচায়ক হতে পারে। সংবাদমাধ্যমের খবরে নজর রাখা যাক। অযোধ্যায় যেদিন রামমন্দির প্রতিষ্ঠা হল, সেদিনই বাংলায় রামের পুজো করলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী কিছু মানুষ। এই বছর রামনবমীর দিনে দেখা গেল অভিনব দৃশ্য। পুষ্পবৃষ্টি থেকে মিষ্টান্ন বিতরণ, যাবতীয় উদ্বেগ, উত্তেজনা পেরিয়ে রামের পুজো নতুন পথ দেখালো। এভাবেও হয়!
চৈতন্য মহাপ্রভুর নির্দেশ
বাংলার ধর্মাচরণ ও ধর্মভাবনায় প্রথম প্রেমরসের ঢেউ তোলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু। সারা ভারতের নিরিখে বাংলার ধর্মভাবনা যে কিছুটা আলাদা, তাঁর নেপথ্যে শ্রীচৈতন্যের ব্যাপক অবদান। সেই অবদানেরই অঙ্গ তাঁর কিছু নির্দেশ। শ্রীচৈতন্য গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিছু ব্রত পালনের জন্য। যার মধ্যে অন্যতম রামনবমী। রামনবমী আদতে একটি ব্রত। ব্রত করতে উপোস থাকতে হয় এই দিন। সন্ধে নাগাদ রামনামসংকীর্তন করে উপোস ভাঙার রীতি। কিন্তু একটি ব্রতের নিয়মকানুন আর একটি উদযাপনের নিয়মকানুন একেবারেই আলাদা। রামনবমী উপলক্ষে ব্যাপক শোভাযাত্রা ও পিস্তল, তলোয়ার ইত্যাদি বিবিধ অস্ত্রপ্রদর্শনী যে ব্রতের অংশ নয়, তা জানাচ্ছেন বর্তমান সময়ে বাংলার বিশিষ্ট পণ্ডিত নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলের ভিডিয়োতে রামনবমীর উদ্দেশ্য-বিধেয় স্পষ্টভাবে কথিত।
বড় প্রশ্ন কোনটা?
বাংলায় রামের পুজো ছিল। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাঙালি নিজের মতো করেও পুজো করেছে। মনের আদলে গড়েও নিয়েছে শ্রীরামকে। কিন্তু বিভিন্ন দেবতার জনপ্রিয়তার নিরিখে বিচার করলে রাম কিছুটা পিছনে। শাক্ত ও বৈষ্ণব সংস্কৃতির অদ্ভুত সুন্দর মিলনভূমি এই বঙ্গদেশ। প্রায় সব দেবতাই এই ভূমিতে আরাধ্যা হয়ে উঠেছেন নানা সময়ে, নানা সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠীর কাছে। তাই বঙ্গজীবনের অঙ্গ কমবেশি বহু দেবতাই। অঞ্চলভেদে বাংলাভাষার যেমন বিবিধ রূপ, তেমনটা এক্ষেত্রেও। রাঢ়বঙ্গের বাংলা না বুঝলে যেমন সেটিকে বাংলা নয় বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না, তেমনই জনপ্রিয়তা কম বলে বাঙালি রামের পুজো করেনি, করে না, এ কথা বলা যায় না। বরং কোন প্রশ্নের উত্তর বেশি জরুরি এখন, সেটাই বিচার্য। রামের পুজো বাঙালির সংস্কৃতির নাকি স্রেফ ভোটব্যাঙ্কে ফায়দা তুলতে কেন রামের শরণাপন্ন হচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল?